সর্বজনীন পেনশন স্কিম ॥ বাস্তবতা ও শরীয়ার নিরিখে

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ॥
বাস্তবতা ও শরীয়ার নিরিখে

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ॥
বাস্তবতা ও শরীয়ার নিরিখে

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

বাংলাদেশ সরকার গত ১৭ আগস্ট ২০২৩ সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে। যদিও কয়েক বছর আগে থেকে এ ধরনের প্রকল্প আসবে বলে শোনা যাচ্ছিল। সর্বশেষ গত বাজেটে এ ধরনের নির্দেশনা রাখা হয়েছে। যা আইনের মাধ্যমে বাস্তব রূপ পেয়েছে।

এই সবর্জনীন পেনশন স্কিমে দেখা যাচ্ছে যেসরকার সর্বস্তরের মানুষকে ষাট বছর বয়সের পর পেনশেনর আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে। 

বাহ্যিক দৃষ্টিতে এবং প্রথম শ্রবণে বিষয়টি তো খুবই সুন্দর ও মধুর বলেই মনে হবে যে কারো কাছে। এবং নিজেদেরকে উন্নয়নমুখী বলে ঘোষণাকারীদেরকে বাস্তবে মানুষ কল্যাণমুখীও মনে করবে। কারণ একটা সরকারের কাজই তো নাগরিকদের প্রয়োজনের সময় সহযোগিতায় এগিয়ে আসা। কিন্তু যখন সর্বজনীন পেনশন স্কিমের নিয়মাবলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হল তখন দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। আপাতদৃষ্টিতে তা অনেকটা ব্যাংকগুলোর ডিপিএসের মতো। ব্যাংকের ডিপোজিট পেনশন স্কিম একাউন্টগুলোতে যেভাবে মানুষ বিভিন্ন মেয়াদে টাকা জমা করতে থাকে এবং মেয়াদান্তে সে কিছু বাড়তি টাকা পায়। এই পেনশন স্কিমও কিছুটা তারই সদৃশ।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম যখন চালু হয় তখন গত মাস (সেপ্টেম্বর ২০২৩)-এর পত্রিকা প্রেসে যাওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত। সে সময় থেকেই পাঠকবর্গের অনেকেই এ নিয়ে মাসিক আলকাউসারের পাতায় শরয়ী বিশ্লেøষণ করার অনুরোধ করে আসছেন। সে সূত্রেই এ বিষয়ে দু-চারটি কথা আরয করা হচ্ছে।

সর্বাগ্রে আলোচিত সর্বজনীন পেনশন স্কিম’-এর স্কিমগুলোর দিকে একটি নজর দেওয়া যাক। চলতি ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের ১৩ তারিখে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী আপাতত চারটি স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে। যেগুলোর নাম যথাক্রমে প্রবাসপ্রগতিসুরক্ষা ও সমতা স্কিম। প্রতিটি স্কিমেই পেনশন প্রত্যাশী ব্যক্তিকে সর্বনিম্ন দশ বছর এবং সর্বোচ্চ ৪২ বছর পর্যন্ত চাঁদা প্রদান করতে হবে।

সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমগুলোর শরয়ী হুকুম নিয়ে আলোচনার পূর্বে একবার দেখে নেওয়া যাকসাধারণ ও বাহ্যিক বিচারে এগুলো কতটুকু জনবান্ধব হল।

ছকে আমরা দেখতে পাচ্ছিএকজন ব্যক্তি তার ষাট বছর বয়সের পর থেকে আমৃত্যু পেনশন প্রাপ্য হবেন। এজন্য তাকে ১০ থেকে ৪২ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে পেনশন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন হারে চাঁদা জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মাসিক চাঁদার হার এবং কত বছর পর্যন্ত চাঁদা জমা করবেÑ সে হিসেবেই নির্ধারিত হবেÑ সে কত টাকা করে পেনশন পাবে এবং তার পরিমাণ কী।

সরকার ঘোষিত ছকটি নিম্নরূপ :

প্রবাস স্কিম

মাসিক চাঁদার হার

,০০০ টাকা

,৫০০ টাকা

১০,০০০ টাকা

চাঁদা প্রদানের মোট সময় (বৎসরে)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

৪২

,৭২,৩২৭

,৫৮,৪৯১

,৪৪,৬৫৫

৪০

,৪৬,০০১

,১৯,০০১

,৯২,০০২

৩৫

৯৫,৯৩৫

,৪৩,৯০২

,৯১,৮৭০

৩০

৬২,৩৩০

৯৩,৪৯৫

,২৪,৬৬০

২৫

৩৯,৭৭৪

৫৯,৬৬১

৭৯,৫৪৮

২০

২৪,৬৩৪

৩৬,৯৫১

৪৯,২৬৮

১৫

১৪,৪৭২

২১,৭০৮

২৮,৯৪৪

১০

,৬৫১

১১,৪৭৭

১৫,৩০২

প্রগতি স্কিম

মাসিক চাঁদার হার

,০০০ টাকা

,০০০ টাকা

,০০০ টাকা

চাঁদা প্রদানের মোট সময় (বৎসরে)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

৪২

৬৮,৯৩১

,০৩,৩৯৬

,৭২,৩২৭

৪০

৫৮,৪০০

৮৭,৬০১

,৪৬,০০১

৩৫

৩৮,৩৭৪

৫৭,৫৬১

৯৫,৯৩৫

৩০

২৪,৯৩২

৩৭,৩৯৮

৬২,৩৩০

২৫

১৫,৯১০

২৩,৮৬৪

৩৯,৭৭৪

২০

,৮৫৪

১৪,৭৮০

২৪,৬৩৪

১৫

,৭৮৯

,৬৮৩

১৪,৪৭২

১০

,০৬০

,৫৯১

,৬৫১

সুরক্ষা স্কিম

মাসিক চাঁদার হার

,০০০ টাকা

,০০০ টাকা

,০০০ টাকা

,০০০ টাকা

চাঁদা প্রদানের মোট সময় (বৎসরে)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

মাসিক পেনশন (টাকা)

৪২

৩৪,৪৬৫

৬৮,৯৩১

,০৩,৩৯৬

,৭২,৩২৭

৪০

২৯,২০০

৫৮,৪০০

৮৭,৬০১

,৪৬,০০১

৩৫

১৯,১৮৭

৩৮,৩৭৪

৫৭,৫৬১

৯৫,৯৩৫

৩০

১২,৪৬৬

২৪,৯৩২

৩৭,৩৯৮

৬২,৩৩০

২৫

,৯৫৫

১৫,৯১০

২৩,৮৬৪

৩৯,৭৭৪

২০

,৯২৭

,৮৫৪

১৪,৭৮০

২৪,৬৩৪

১৫

,৮৯৪

,৭৮৯

,৬৮৩

১৪,৪৭২

১০

,৫৩০

,০৬০

,৫৯১

,৬৫১

সমতা স্কিম

মাসিক চাঁদার হার

,০০০ টাকা

(চাঁদাদাতা ৫০০ টাকা + সরকারি অংশ ৫০০ টাকা)

চাঁদা প্রদানের মোট সময় (বৎসরে)

মাসিক পেনশন (টাকা)

৪২

৩৪,৪৬৫

৪০

২৯,২০০

৩৫

১৯,১৮৭

৩০

১২,৪৬৬

২৫

,৯৫৫

২০

,৯২৭

১৫

,৮৯৪

১০

,৫৩০

উপরের ছকের দিকে আরেকবার নজর দেওয়া যাক।

এতে দেখা যাচ্ছে যেপেনশন প্রত্যাশীদের থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য চারটি ভিন্ন ভিন্ন স্কিম গঠন করা হয়েছে। যেগুলের নাম যথাক্রমে প্রবাসপ্রগতিসুরক্ষা ও সমতা স্কিম। প্রত্যেকটি স্কিমেই একজন নাগরিককে সর্বোচ্চ ৪২ বছর এবং সর্বনিম্ন ১০ বছর পেনশন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন হারে চাঁদা প্রদান করতে বলা হয়েছে। যেহেতু পেনশন প্রদান শুরু হবে চাঁদাদাতার ৬০ বছর বয়স থেকেতাই ৪২ বছর চাঁদা প্রদান করতে হলে তাকে ১৮ বছর বয়স থেকে তা দেওয়া শুরু করতে হবে। দিয়ে যেতে হবে ৫০৪ মাস পর্যন্ত। অন্যদিকে পেনশনের চাঁদা দেওয়া শুরু করার সর্বোচ্চ বয়স দেখা যাচ্ছে ৫০ বছর। কারণ কেউ পেনশনের আওতায় আসতে হলে তাকে ন্যূনতম ১০ বছর অর্থাৎ ১২০ মাস পর্যন্ত বিরতিহীন চাঁদা দিয়ে যেতে হবে।

এবার নজর দেওয়া যাক চাঁদার পরিমাণ ও প্রতিশ্রুত পেনশনের পরিমাণের দিকে।

উদাহরণস্বরূপপ্রগতি স্কিমে একজন ব্যক্তি যদি ১২০ কিস্তি পর্যন্ত ১০ বছরে ২,০০০ টাকা করে চাঁদা জমা করে যায়তাহলে সেটির পরিমাণ হবে (২,০০০×১২×১০=) ২,৪০,০০০/- টাকা। এমনিভাবে যে ব্যক্তি ১৫ বছর উক্ত পরিমাণ চাঁদা জমা করবে তার জমার স্থিতি দাঁড়াবে ৩,৬০,০০০/- টাকা। আর ২০ বছর জমা করলে তার যোগফল হবে ৪,৮০,০০০ টাকা। এখন এ জমার বিপরীতে তাকে কী পরিমাণ টাকা এবং কতদিন পর্যন্ত পেনশন প্রদান করা হবেÑ সে বর্ণনা রয়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা২০২৩’-এ। সেখানে যা বলা হয়েছে তার সারমর্ম হলএকজন চাঁদাদাতা তার ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। মৃত্যু পর্যন্ত তা পেতে থাকবেন। আর যদি আগেই তার মৃত্যু হয়ে যায়তাহলে তার ৭৫ বছর বয়স হিসাব করে সে পর্যন্ত তার নমিনি নির্ধারিত হারে পেনশনের টাকা পাবেন। যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছেকিন্তু সার্বিকভাবে এ দেশে ৭০-ঊর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা এখনো অনেক কম। আর ৭৫-ঊর্ধ্ব লোকের সংখ্যা যে পরিমাণে বেশ কমÑ তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সে হিসেবে ধরে নেওয়া যায় যেখুব সামান্য ক্ষেত্রেই তখনকার সরকারকে ১৫ বছরের বেশি সময় কোনো ব্যক্তিকে পেনশনের টাকা প্রদান করতে হবে। একটি ধারণা নেওয়ার সুবিধার্থে আমরা ১৫ বছরকে মূল ধরে উদাহরণ টানতে পারি।

ধরে নেওয়া যাক যেসরকার গড়ে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আসা নাগরিকদের ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত ১৫ বছর তথা ১৮০ মাস পেনশন প্রদান করবে। সেক্ষেত্রে যে ব্যক্তি মাসে ২,০০০ টাকা করে ১০ বছর তথা ১২০ মাস চাঁদা প্রদান করেছে সে তার জমাকৃত ২,৪০,০০০ টাকার বিপরীতে ১০ বছর পর থেকে শুরু করে ১৫ বছর পর্যন্ত মাসিক ৩,০৬০ করে পাবে (৩,০৬০×১৮০=) ৫,৫০,৮০০/- টাকা। অন্যদিকে যে মাসে ২,০০০ করে ১৫ বছর চাঁদা দেবেসে তার জমাকৃত ৩,৬০,০০০ টাকার বিপরীতে মাসিক ৫,৭৮৯ টাকা করে ১৫ বছরে পাবে (৫,৭৮৯×১৮০=) ১০,৪২,০২০ টাকা। অর্থাৎ ১০ বছর চাঁদা জমাদানকারী দ্বিগুণের কিছু বেশি এবং ১৫ বছর চাঁদাদানকারী তার জমাকৃত অর্থের তিন গুণের কিছু বেশি পরিমাণ পেনশন সুবিধা পাবে।

পেনশন বাহ্যিক দিক থেকে কতটুকু লাভজনক

উপরের সংক্ষিপ্ত চিত্রটির প্রতি নজর দিলে বাজারমূল্য ও প্রচলিত মুদ্রা নিয়ে মোটামুটি ধারণা রাখেনএমন যে কোনো ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন যেএটি নাগরিকদের জন্য আর্থিক দৃষ্টিতে আহামরি কিছু হয়নিবরং একজন ব্যক্তি ওভাবে টাকা জমা না রেখে যদি সে অন্য কেনো সম্পদে তা বিনিয়োগ করে রাখেতাহলে সে লাভবান হবে বেশি। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। যদি আমরা বিগত কয়েক মাসের চিত্র ধরিতাহলে দেখতে পাব যেএক বছরেরও কম সময়ে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে ৩০%-এর বেশি। আর স্বাধীনতার সময় তো ডলার ছিল ৭.৫ টাকা। ৮৭/৮৮ সন অর্থাৎ ৯০ দশকের শেষের দিকেও ছিল ৩০/৩৫ টাকার মধ্যে। এখন যা সরকারি হিসাবেই ১১১ টাকার বেশি। এখান থেকে মুদ্রাস্ফীতির চিত্রটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।

তাহলে এখন যার ১৮ বছর বয়স সে ৪২ বছর টাকা জমা করার পর যখন পেনশন পাবে তখন সে মুদ্রার মূল্য থাকবে কতএমন তো নয় যেতার জমাকৃত অর্থের ১০ গুণ তাকে প্রদান করা হলকিন্তু বাজার শক্তির হিসেবে তার মূল্য কমে গেছে আগের থেকে বিশ গুণ। সেক্ষেত্রে লোকটি কি ১০ গুণ বেশি পেল নাকি ১০ গুণ কম পেল। কাগুজে মুদ্রা হয়তো পেয়ে গেছে বহু গুণ বেশিকিন্তু সেটির মূল্যমান নেমে এসেছে আগের থেকে অর্ধেকে। বিষয়টিকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হিসাব। বৈদেশিক মুদ্রার সাথে টাকার বিনিময় হারের তুলনা না করলেও যদি আমরা ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনা করিতাহলে দেখতে পাবযতই দিন যাচ্ছে কাগুজে নোট তার ক্রয়শক্তি হারাচ্ছে। মুরব্বিদের থেকে শোনা ইতিহাসে নজর দেওয়া লাগবে নাবরং ৩০/৪০ বছর বয়স হয়ে যাওয়া যেকোনো ব্যক্তিই তার আগের ১০/২০ বছরের নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য এবং বর্তমান বাজারমূল্য তুলনা করলেই আকাশ-পাতালের ফারাক স্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন। কয়েক গুণ বেতন বেড়ে যাওয়ার পরও হালালভাবে চলতে যাওয়া লোকদের মাসিক খরচাদি নির্বাহে প্রায় হিমশিম খেতে হয়।

এখন তো বছরে বছরেই প্রায় স্বীকৃতভাবেই ১০/১২% মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। যদিও অভিজ্ঞ মহলের মতেবাস্তবে তার পরিমণ আরো অনেক বেশি। তো যদি ১০/১২%-ও ধরে নেওয়া হয়তাহলে এখনকার টাকা দিয়ে যা কেনা যাচ্ছেপ্রতি বছর ১০/১২% মূল্যস্ফীতির পর ১০/১৫/২০ বছর পর এবং আরও বাড়িয়ে বললে ৪২ বছর পর কি তা কেনা যাবে?! তখন যদি ২০/২৫ গুণ বাড়িয়েও টাকা দেওয়া হয়সেটি কি এখনকার ক্রয়ক্ষমতার সমান হবেবোঝা যাচ্ছে যেসর্বজনীন পেনশন স্কিমে বাহ্যিক বিচারেও নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। কারণ ছাপানো কাগজের নোটের বিনিময়ে ১০/১৫/২০ বছর বা ৪২ বছর পরে সরকার এরকম নোটই তাকে বেশি হারে প্রদান করবে। সাধারণ বিচারে যার মূল্য এখনকার তুলনায় থাকবে তলানিতে। চালডালতেল মাছ-গোশত ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এগুলোর পাঁচ বছর আগের মূল্য১০ বছর আগের মূল্য বা ২০ বছর আগের মূল্য এখনকার সাথে তুলনা করলেই যেকোনো ব্যক্তি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন। যদি সরকার নাগরিক স্বার্থই দেখততবে পেনশন প্রাপ্তির বিষয়টির সাথে মূল্যস্ফীতিমুদ্রাস্ফীতিকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো স্বীকৃত নীতিতে (মেথড) তার পরিমাণ ঠিক করত। অথবা স্বীকৃত কোনো খনিজ পদার্থ যেমন সোনারুপা এসবকে বিবেচনায় আনত। এখন যা করা হয়েছেতা হয়ে গিয়েছে অনেকটা ব্যাংকগুলোর ডিপিএস তথা ডিপোজিট পেনশন স্কিমের মতো। ব্যাংকগুলোতে যে রকম সীমিত আয়ের লোকেরা অল্প অল্প করে কিছু বছর পর্যন্ত টাকা জমা করে একপর্যায়ে বেশি পরিমাণে তা পেয়ে থাকে আর ব্যাংকগুলো তাতে ওয়েটেজ দেওয়ার দাবি করে থাকে, ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিমও অনেকটা তেমনই হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির কারণে মাঝে কয়েক বছর সুদহার কম থাকলেও এখন যেভাবে তা আবার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাতেও নিশ্চয়ই আগের মতো জমাকারীদের টাকা ৫ বছরে দ্বিগুণ১০ বছরে ৩ গুণ বা তারও বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার বিভিন্ন প্রোডাক্ট শুরু হবে ব্যাংকগুলোতে। অথচ এসবেও যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছেতা তো ওয়াকিবহাল মহলের কাছে অস্পষ্ট নয়। কারণ আমাদের মতো দেশে যেভাবে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি গাণিতিক হারে বাড়তে থাকেসেখানে পরিমাণে বেশি দেখা গেলেও বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই আগের চেয়ে মূল্যের বিবেচনায় কমে যায়।

ধরে নিন বছর খানেক আগে কেউ এক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রেখেছে। তখন ডলারের দাম ছিল ৮০/৮৫ টাকার মধ্যে। যদি আমরা ৮৫ টাকাও ধরি তাহলে তার এক লক্ষ টাকার মূল্য ছিল ১,১৭৬ ডলার। এখন যদি বর্তমানে তাকে ৬% সুদসহ ঐ টাকা ফেরত দেওয়া হয় তাহলে সে পাচ্ছে ১,০৬,০০০ টাকা (যদিও বাস্তবে সে তা পাবে না। কারণ সেখান থেকে সরকার কর নিয়ে যাবে ১০/১৫%এছাড়া এক্সেস ডিউটিব্যাংক মেইন্টেনেন্স ফিকার্ড ফিএসএমএস ফি এরকম বিভিন্ন নামে আরো চার্জ তো রয়েছেই।) আর বর্তমান বাজারে সরকার নির্ধারিত ডলারের দাম ধরলেও ১১১ টাকা প্রতি ডলার (যদিও বাইরে তা ১২০ টাকা বলে শোনা যাচ্ছে।) হিসাবে সে পাচ্ছে ৯৫৫ ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা। অথচ সে এক বছর আগে জমা করেছিল ১,১৭৬ ডলার মূল্যমানের মুদ্রা। অর্থাৎ সুদ পাওয়ার পরও তার মুদ্রার ক্ষমতা কমে গেছে ২০%-এরও বেশি।

আর মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বেশি বুঝিয়ে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। পড়াশোনায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি এমন লোকেরা বাজারে গেলেও এখনকার কাগুজে নোটকে কচুপাতাকলাপাতা বলে বকা দিয়ে থাকে। মূল্যস্ফীতির পরিভাষা তারা না বুঝলেও টাকার ক্রয়ক্ষমতা হারানোর বিষয়টি তাদের কাছেও স্পষ্ট।

সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দাঁড়ায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম’-এ কে লাভবান বেশি হবেসরকারনা চাঁদাদাতা নাগরিক?

সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিভিন্ন ধারা-উপধারা নিয়ে বলার আছে অনেক কিছুই। সার্বিক বিচারে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এর চুলচেরা আরও বিশ্লেষণ করারও সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আলকাউসারের পাঠকগণ যেহেতু মূলত এর শরয়ী বিষয়টিই জানতে বেশি আগ্রহীতাই এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে আমরা এই স্কিমের শরীয়া বিশ্লেষণের দিকে অগ্রসর হওয়া সমীচীন মনে করছি। তবে এর আগে একটি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গ চাঁদা প্রদানে বিলম্ব

সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি যেহেতু একটি দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিভিত্তিক প্রকল্পতাই এখানে যারা নিবন্ধিত হবেতাদের একটি বিশাল অংশই যে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করবে নাবরং বিভিন্ন ওজরে অনাগ্রহ বা অনীহায় একটা পর্যায়ে তা বন্ধ করে দেবেএতে কেনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আবার অনেক লোক এমনও থাকবেযারা হয়তো চাঁদা প্রদান শুরু করেছেকিন্তু মাঝে দিতে পারেনি। আবার সে দু-চার বছর পর দেওয়া শুরু করবে। তাদের বিষয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা২০২৩’-এ কিছু নির্দেশনা পাওয়া যায়। সেটিতে যাওয়ার আগে একথা বলে রাখা প্রয়োজন যেএ ধরনের স্কিমে এমন লোকের সংখ্যা বেশি পরিমাণে হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারেবীমা কোম্পানিগুলোর জীবন বীমা পলিসিকে। যেখানে বীমা কোম্পানির এজেন্টদের চাপাচাপি এবং তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই বীমা পলিসি খরিদ করে থাকে। কিন্তু দু-চারটি প্রিমিয়াম দেওয়ার পর অথবা কেউ কয়েক বছর প্রিমিয়াম দেওয়ার পর তা আর চালু রাখে না। সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আসা লোকদের একটি বড় অংশই যে এমন হবেÑ তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

এখন দেখা যাকএমন লোকদের জন্য এই স্কিমে কী বিধান রাখা হয়েছে?

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা২০২৩’-এর ধারা ৫-এর উপধারা ৪-এ উল্লেখ রয়েছেÑ

৫। মাসিক চাঁদা প্রদান। …

(৪) নির্ধারিত তারিখের মধ্যে চাঁদা জমা করিতে ব্যর্থ হইলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া চাঁদা প্রদান করা যাইবে এবং এক মাস অতিবাহিত হইলে পরবর্তী প্রতি দিনের জন্য ১% হারে বিলম্ব ফি জমা প্রদান সাপেক্ষে হিসাবটি সচল রাখা যাইবে। 

আর উপধারা ৫-এ বলা হয়েছেÑ

(৫) কোনো চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে ৩ (তিন) কিস্তি চাঁদা জমাদানে ব্যর্থ হইলে তাহার পেনশন হিসাবটি স্থগিত হইবে এবং প্রতিদিনের জন্য উপ-বিধি (৪) অনুযায়ী সমুদয় বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত হিসাবটি সচল করা হইবে না।

উপরে বর্ণিত দুটি উপধারা আবার পড়ে নিন। বিশেষত উপধারা ৫-এর দিকে আরেকবার নজর দিন। এবার ধারণা করিএকজন চাঁদাদাতা ১০ বছরের জন্য কোনো স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হল এবং ৯ বছর ধারাবাহিক চাঁদা দিয়ে গেলএরপর আর দিতে পারল না। তাহলে তার ক্ষেত্রে কী ঘটবে?

ধারা ৫-এর উপধারা ৫ বলছেসে যদি বকেয়া টাকা বিলম্ব ফিসহ আদায় না করে তাহলে তার হিসাবটি সচল করা হবে না। এখন একজন লোক যদি মাসিক ১০,০০০ টাকা করে ৯ বছর চাঁদা আদায় করে (১০০০০×১০৮) তাহলে বছরে ১,২০,০০০ টাকা হিসেবে ৯ বছরে জমা করেছে ১০,৮০,০০০ টাকা। এরপর আর্থিক দুর্গতিশারীরিক অসুস্থতা অথবা হঠাৎ কোনো বিপদে পড়ে সে আর চাঁদা দিতে পারল না। আর তার নমিনি বা নিকটাত্মীয়ও আর্থিকভাবে এত সক্ষম নয় যেতার চাঁদা আদায় করবে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার পাশে না দাঁড়িয়ে তার টাকা জব্দ করে তার মাথায় ছড়ি ঘুরাবে?

এটা কি কাবুলিওয়ালানা জনগণের করে পরিচালিত হওয়া একটি প্রজাতন্ত্র?!

বিলম্ব ফিনা ডাকাতি!

ধারা ৫-এর উপধারা ৪-এর কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। যেখানে বলা আছেনির্ধারিত তারিখের এক মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে পরবর্তী প্রতিদিনের  জন্য ১% হারে বিলম্ব ফি জমাপ্রদান সাপেক্ষে হিসাবটি সচল রাখা যাবে। এক দিনে ১% তাহলে ৩০ দিনে ৩০%। বছরে ৩৬৫%। অর্থাৎ ১০,০০০ টাকার ৪টি কিস্তি যদি কারো বাকি থাকে এবং সে যদি তার হিসাবটি সচল করতে যায় তাহলে ৯০ দিন বিলম্বের জন্য তাকে দৈনিক ১% করে ২৭,০০০ টাকা বিলম্ব ফিসহ মোট ৩০,০০০+২৭,০০০=৫৭,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। আর এক বছর বিলম্বের কথা কি বলা উচিত?  তবুও একবার দেখে নেওয়া যাক। ধরে নেওয়া যাককারো এক লক্ষ টাকা বকেয়া পড়েছে। এখন এক বছর পর সে তার হিসাবটি সচল করতে গিয়েছে। তাকে কত বিলম্ব ফি দিতে হবে? ‘জাতীয় পেনশন স্কিম বিধিমালা২০২৩,-এর ধারা-৫-এর উপধারা ৪ বলছেতাকে দৈনিক ১% হারে বিলম্ব ফি দিতে হবে। অর্থাৎ ১,০০,০০০×১% ×৩৬৫=৩,৬৫,০০০। মূল টাকা ১,০০,০০০ আর বিলম্ব ফি ৩,৬৫,০০০। এ হিসাব যারা একটু খেয়াল করে দেখবেনতাদের হয়তো সন্দেহ হবে যেপেনশন স্কিমের এ বিধিমালা যারা বসিয়েছেন তাদের ওপর মারওয়ারি বা কাবুলিওয়ালা বা এদেশের একশ্রেণির রক্তচোষা এনজিও ও সুদখোরদের প্রেতাত্মা ভর করেনি তো?

আসলে প্রেতাত্মা বলে কোনো কথা নেইবরং একতরফাভাবে মুনাফা ও তেলের মাথায় তেল দেওয়ার চিন্তাকেন্দ্রিক সেবার নামে নিজের সুবিধা আদায় করে নেওয়া পুঁজিবাদের শাগরিদরা যুগে যুগে পোশাক ও খোলস পাল্টালেও এদের রূহ ও আত্মা কিন্তু একই থাকে।

এতো গেল সর্বজনীন পেনশন স্কিম-এর নীতিমালায় খোলাচোখে দেখা কিছু অসঙ্গতি ও গণবিমুখতা। যে প্রকল্পকে দেখানো হচ্ছে জনস্বার্থকর ও গণমানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রবর্তিতবাস্তবে কি সেটি তা-ই?!

যাক সে কথা। আজকে আমাদের মূল উদ্দেশ্য সেটি বলা নয়। এখন আসা যাকযে জন্য এ নিবন্ধ লিখতে পাঠকগণ ফরমায়েশ করে যাচ্ছেন সেদিকে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এর শরয়ী বিশ্লেষণ

শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়এতে সুস্পষ্টভাবেই শরীয়তের নিষিদ্ধ রিবাআলগারার ও আলমাইসির এবং আকলু মালিল গায়র বিলবাতিল ইত্যাদি বিষয়গুলো বিদ্যমান।

রিবান নাসীআহ (ربا النسيئة)

রিবান নাসীআহ হল কুরআন কারীমে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ একটি রিবা। বর্তমানে আর্থিক লেনদেনগুলোতে প্রচলিত সুদ বা ইন্টারেস্ট সে রিবারই একটি প্রকার। কুরআনে নিষিদ্ধ রিবা হচ্ছেÑ

والربا الذي كانت العرب تعرفه وتفعله، إنما كان قرض الدراهم والدنانير إلى أجل، بزيادة على مقدار ما استقرض على ما يتراضون به.

ولم يكونوا يعرفون البيع بالنقد، وإذا كان متفاضلا من جنس واحد، هذا كان المتعارف المشهور بينهمولذلك قال الله تعالى وَ مَاۤ اٰتَیْتُمْ مِّنْ رِّبًا لِّیَرْبُوَاۡ فِیْۤ اَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا یَرْبُوْا عِنْدَ اللّٰهِ، فأخبر أن تلك الزيادة المشروطة إنما كانت ربا في المال العين، لأنه لا عوض لها من جهة المقرض.

অর্থাৎ আরবের প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ রিবা হলনির্দিষ্ট মেয়াদে দিরহামদীনার (মুদ্রা) ধার দিয়ে উভয়ের সম্মতিতে অক্তিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা। Ñআহকামুল কুরআনজাসসাস ১/৪৬৫

উসামা ইবনে যায়েদ রা.-এর সূত্রে বর্ণিতআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ

إنما الربا في النسيئة.

অর্থ : রিবা হল ধার (মেয়াদী লেনদেন)-এর ক্ষেত্রে। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ১৫৯৬

অর্থাৎ কাউকে অর্থকড়ি ধার দিয়ে বা নিয়ে পরবর্তীতে তা পরিমাণে বাড়িয়ে নেওয়া বা দেওয়াই হল রিবান নাসীআহ। সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এ এটির উপস্থিতি একেবারেই পরিষ্কার। কারণ এ পেনশন চুক্তিটি  কিছু টাকা প্রদান করে নির্ধারিত মেয়াদের পর অতিরিক্ত টাকা গ্রহণের। অর্থাৎ চাঁদাদাতা যে পরিমাণ টাকা আদায় করবেসরকার এর বিনিময়ে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ টাকা পেনশন হিসেবে পরিশোধ করবে।

ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আছেÑ এমন যেকোনো ব্যক্তিই জানেনইসলামে রিবান নাসীআহ তথা প্রচলিত সুদের ব্যাপারে কী ধরনের নিষেধাজ্ঞা ও কঠোরতা রয়েছে। এখানে নমুনাস্বরূপ দু-তিনটি আয়াত ও হাদীস পেশ করা হচ্ছে।

প্রথম আয়াত :

اَلَّذِیْنَ یَاْكُلُوْنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوْمُوْنَ اِلَّا كَمَا یَقُوْمُ الَّذِیْ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیْطٰنُ مِنَ الْمَسِّ، ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ قَالُوْۤا اِنَّمَا الْبَیْعُ مِثْلُ الرِّبٰوا، وَ اَحَلَّ اللهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا،  فَمَنْ جَآءَهٗ مَوْعِظَةٌ مِّنْ رَّبِّهٖ فَانْتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ وَ اَمْرُهٗۤ اِلَی اللهِ، وَ مَنْ عَادَ فَاُولٰٓىِٕكَ اَصْحٰبُ النَّارِ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ.

যারা সুদ খায়তারা (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবেযাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এজন্য যেতারা বলেক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। যার নিকট তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছেতবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই। আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় করবে তারাই জাহান্নামের অধিকারী হবে। সেখানে তারা হবে চিরস্থায়ী। Ñসূরা বাকারা (০২) : ২৭৫

দ্বিতীয় আয়াত :

يَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰوا وَ يُرْبِي الصَّدَقٰتِ وَ اللهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ اَثِيْمٍ.

আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না। Ñসূরা বাকারা (০২) : ২৭৬

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সুদ থেকে অর্জিত অর্থ বা তার বরকত নষ্ট করে দেন। আর সদকা দানকারীর অর্থ-সম্পদ বা তার বরকত বৃদ্ধি করে দেন।

তৃতীয় আয়াত :

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِيْنَ، فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ اِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوْسُ اَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُوْنَ وَ لَا تُظْلَمُوْنَ .

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও। যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। আর যদি তোমরা তওবা কর তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা (কারো প্রতি) জুলুম করবে না এবং তোমাদের প্রতিও জুলুম করা হবে না। Ñসূরা বাকারা (০২) : ২৭৮-২৭৯

চতুর্থ আয়াত :

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوا الرِّبٰۤوا اَضْعَافًا مُّضٰعَفَةً  وَّ اتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.

হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেও না এবং আল্লাহকে ভয় করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। Ñসূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৩০

কয়েকটি হাদীস :

হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ

اجْتَنِبُوا السّبْعَ المُوبِقَاتِ، قَالُوايَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنّ؟ قَالَالشِّرْكُ بِاللهِ… وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ اليَتِيمِ

অর্থাৎ তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থেকো। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনহে আল্লাহর রাসূল! সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কীতিনি ইরশাদ করলেনআল্লাহর সাথে শরীক করাজাদু করাঅন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করাযা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। সুদ খাওয়া। এতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা। জিহাদের ময়দান থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে যাওয়া। সতী-সাধ্বী সরলমনা-উদাসীনা মুমিন নারীর বিরুদ্ধে অপকর্মের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। Ñসহীহ বুখারীহাদীস ২৭৬৬সহীহ মুসলিমহাদীস ৮৯সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৮৭৪সুনানে নাসায়ীহাদীস ৩৬৭১

হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি স্বপ্নের কথা বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছেÑ

‘‘আমি দেখলামআজ রাতে আমার কাছে দুজন মানুষ এল এবং তারা আমাকে একটি পবিত্র ভূখণ্ডে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্তের নদীর কিনারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেই নদীতে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে আর নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন। কিনারে দাঁড়ানো লোকটির সামনে রয়েছে পাথর। যখন নদীর লোকটি কিনারে উঠতে চায় তখন কিনারে থাকা লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরের আঘাতে লোকটি যেখানে ছিল সেখানে ফিরে যায়। এরপর সে আবারও নদীর কিনারে আসতে চায়। এভাবে সে যখনই কিনারে আসতে চায়তখনই তাকে পাথর মেরে আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

আমি আমার সাথে থাকা লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলামরক্তের নদীতে অবস্থিত লোকটিযার মুখের ওপর পাথর মেরে আপন জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছেসে লোকটি কেতখন তাদের একজন আমাকে বললেনএ লোকটি সুদখোর। Ñসহীহ বুখারীহাদীস ১৩৮৬২০৮৫

উল্লেখ্যআম্বিয়ায়ে কেরামের স্বপ্ন পুরোপুরি সত্য হয় এবং সেটিও ওহীর হুকুমে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছেÑ

لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَه.

সুদগ্রহিতা ও সুদদাতা উভয়কেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন। Ñসহীহ মুসলিমহাদীস ১৫৯৭জামে তিরমিযীহাদীস ১২০৬সুনানে নাসায়ীহাদীস ৫১০৪

অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছেÑ

لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤكِلَه، وَشَاهِدَيْهِ، وَكَاتِبَه.

সুদগ্রহিতাসুদদাতাসুদের সাক্ষী ও সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি যে লিখে দেয়তাদের সকলের প্রতি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন। Ñমুসনাদে আহমাদহাদীস ৬৬০সুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৩৩৩জামে তিরমিযীহাদীস ১২০৬

আলগারারআলমাইসির

আর্থিক লেনদেনে শরীয়তের নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর মধ্যে দুটি বিষয় হচ্ছেআলগারার ও আলমাইসির।

হাদীস শরীফে এসেছেÑ

نهى عن بيع الغرر.

অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লেনদেনে সব ধরনের غرر নিষিদ্ধ করেছেন। Ñসহীহ মুসলিম ২/২জামে তিরমিযী ১/২৩৩সুনানে আবু দাউদ ২/১২৩

ফিকাহবিদগণ বলেছেনএই হাদীস শরীয়তের মৌলনীতির অন্তর্ভুক্ত। এটি যেকোনো কারবারের ক্ষেত্রে মূলনীতি। নিষিদ্ধ বেচাকেনার অনেক প্রকার এমন রয়েছেযার ব্যাপারে সরাসরি কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। যেগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে এই গারার

আইম্মায়ে ফিকহ উল্লিখিত মৌলিক নীতিমালা এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য দলীলাদি সামনে রেখে গারার’-এর বেশ কিছু সংজ্ঞা পেশ করেছেন। এরপর গারার’-এর ক্ষেত্রসমূহ একেকটি করে বর্ণনা করে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যেএ বিষয়গুলো নিষিদ্ধ গারার’-এর অন্তর্ভুক্ত।

গারারের কয়েকটি সংজ্ঞা

ইমাম সারাখসী রাহ. বলেনÑ

ما يكون مستور العاقبة.

যার পরিণাম অস্পষ্ট তা-ই গারার।’ Ñআলমাবসূত ১২/১৯৪

ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেনÑ 

الغرر هو مجهول العاقبة، فإن بيعه من الميسر الذي هو القمار.

গারার হচ্ছে ঐ কারবারযার পরিণাম অনিশ্চিত। কারণ এর দ্বারা সেটা ميسر (মাইসির)-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়যা জুয়ারই অপর নাম।’ Ñমাজমুআতু ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৯/২২

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনÑ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَ الْمَیْسِرُ وَ الْاَنْصَابُ وَ الْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْهُ  لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.

হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদজুয়াপূজার বস্তু ও জুয়ার তীর অপবিত্রশয়তানের কাজ। অতএব এসব থেকে দূরে থাকযাতে তোমরা সফলকাম হও। Ñসূরা মায়েদা (০৫) : ৯০

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিতআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ

إنَّ اللهَ حرَّم عليكم الخمرَ، والميسِرَ، والكُوبةَ.

আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর মদজুয়া ও পাশা হারাম করেছেন। Ñসুনানে আবু দাউদহাদীস ৩৬৯৬সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৩৬৫

শরীয়তে মাইসির অর্থ হচ্ছেকিমার তথা জুয়া। জেনে রাখা ভালোবর্তমানে জনগণের কাছে জুয়া হিসেবে পরিচিত যেসকল কারবার রয়েছেএগুলোরও প্রায় সবগুলোই শরীয়তের দৃষ্টিতে কিমার তথা জুয়া। কিন্তু শরীয়তে জুয়া এখানেই সীমাবদ্ধ নয়বরং এর আওতা আরো বিস্তৃত। যেমনদ্বিপক্ষীয় একটি চুক্তিতে এক পক্ষ টাকা আদায়ের পর এর বিনিময়ে সে বড় কিছু পেতে পারে বা নাও পেতে পারেÑ এমন চুক্তি জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। (প্রচলিত লটারিগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত)। (দ্র. আহকামুল কুরআনজাসসাস ২/৪৬৫তাফসীরে কুরতুবী ৩/৩৬)

এছাড়া টাকা লেন-দেনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে এক পক্ষ টাকা পরিশোধ করলকিন্তু এর বিনিময়ে অপর পক্ষ থেকে সে কত পেতে পারেÑ তা সুনিশ্চিত হল নাবরং তা ভবিষ্যতের সাথে ঝুলে থাকলÑ এমন চুক্তিও মাইসির তথা নিষিদ্ধ জুয়ার একটি প্রকার।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এ আলগারার ও আলমাইসির-এর উপস্থিতি

সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এ এই আলগারার ও আলমাইসির-এর উপস্থিতির বিষয়টিও স্পষ্ট। কারণ এখানে একজন পেনশন প্রত্যাশী চাঁদাদাতা সুনিশ্চিতভাবে একথা জানে না যেতার প্রদানকৃত চাঁদার বিপরীতে সে বা তার নমিনি কত টাকা ফেরত পাবে। কথাটি বোঝার জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন২০২৩’ ও সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা২০২৩’-এর কয়েকটি ধারা-উপধারা দেখা যেতে পারে। 

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন২০২৩’-এর ধারা ১৪-এর উপধারা ঞট ও ঠ-এ উল্লেখ আছেÑ

১৪। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা। …

(ঞ) পেনশনারগণ আজীবন অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশন সুবিধা ভোগ করিবেন;

(ট) পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ (পঁচাত্তর) বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে মৃত্যুবরণ করিলে পেনশনারের নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ (পঁচাত্তর) বৎসর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন প্রাপ্য হইবেন;

(ঠ) চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ (দশ) বৎসর চাঁদা প্রদান করিবার পূর্বে মৃত্যুবরণ করিলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তাহার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হইবে।

আর সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ২০২৩-এর ধারা-১৬-এর উপধারা ৪৫ ও ৬ এ উল্লেখ আছেÑ

১৬। চাঁদাদাতা বা পেনশনারের মৃত্যুর পর স্কিমের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থ প্রদান।

(৪) কোনো স্কিমের চাঁদাদাতা মাসিক পেনশন প্রাপ্যতা অর্জিত হইবার পর মৃত্যুবরণ করিলে উক্ত স্কিমে জমাকৃত পুঞ্জীভূত অর্থের ভিত্তিতে পেনশন নির্ধারণপূর্বক তাহার নমিনি বা নমিনিগণকে অথবা নমিনি না থাকিলে তাহার উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীগণকে পেনশন প্রদান করা যাইবে এবং এই ক্ষেত্রে উপ-বিধি (৫) এর বিধান প্রযোজ্য হইবে।

(৫) এই বিধির আওতায় কোনো স্কিমের চাঁদাদাতা পেনশনে থাকাকালীন তাহার বয়স ৭৫ (পঁচাত্তর) বৎসর পূর্ণ হইবার পূর্বে মৃত্যুবরণ করিলে পেনশনারের নমিনি বা নমিনিগণ অথবা নমিনি না থাকিলে তাহার উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীগণ অবশিষ্ট সময়ের জন্য অর্থাৎ মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ (পঁচাত্তর) বৎসর পূর্ণ হইতে যতদিন অবশিষ্ট থাকিবে ততদিন পর্যন্ত মাসিক পেনশন প্রাপ্য হইবেন।

(৬) কোনো স্কিমের চাঁদাদাতা মাসিক পেনশন প্রাপ্যতা অর্জিত হইবার পূর্বে মৃত্যুবরণ করিলে তাহার নমিনি বা নমিনিগণ অথবা নমিনির অবর্তমানে উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীগণ মুনাফাসহ জমাকৃত অর্থ ফেরত পাইবেন।

উপরের ধারা-উপধারাগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যেএকই পরিমাণ চাঁদা আদায়কারী ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে পেনশন প্রাপ্তির মোট অংকের পরিমাণ বিভিন্ন রকম হবে। যে ব্যক্তি শতবর্ষী হবে সে ৭৫ বছর বেঁচে থাকা একজন চাঁদাদাতা থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি পাবে। কেউ আরো বেশি বছর বেঁচে থাকলে সে আরো বেশি পাবে। অর্থাৎ চাঁদাদাতা ব্যক্তির কখনো এটা জানার সুযোগ নেই যেআসলে সে মোট কত টাকা ফেরত পাবে। কারণ মৃত্যুর দিনটি তো কারোরই জানা নেই। এমনিভাবে কোনো চাঁদাদাতা চাঁদা দেওয়ার মধ্য মেয়াদে মারা গেলে তার সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। কারণ সেক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে তার নমিনি বা নমিনিগণ অথবা নমিনির অবর্তমানে উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীগণ সুদসহ শুধু মূল টাকাই ফেরত পাবে। কোনো পেনশন সুবিধা পাবে না। (বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন পদ্ধতিতে দেখা যায়চাকরিজীবী মারা যাওয়ার পরও তার বেঁচে থাকা স্ত্রী ও ক্ষেত্রবিশেষে তার নাবালেগ সন্তানগণ পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সেটি নেই।)

আর যদি কোনো চাঁদাদাতা পেনশনে থাকাকালীন তার বয়স ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করে তাহলে সেক্ষেত্রে নমিনিগণ চাঁদাদাতার বয়স ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাবে। অর্থাৎ চাঁদাদাতা বা নমিনি কেউই তাদের প্রদানকৃত অর্থের বিপরীতে কত টাকা ফেরত পাবে এবং কতদিন ফেরত পাবেÑ তা আগে থেকে জানে না। আর এটিই হচ্ছে সেই নিষিদ্ধ مستور العاقبة তথা পরিণাম অস্পষ্ট দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও কারবারযেখানে শরীয়া নিষিদ্ধ আলগারার ও আলমাইসির নিহিত রয়েছে।  

আকলু মালিল গায়র বিলবাতিল-এর উপস্থিতি

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা২০২৩’-এ আর্থিক জরিমানার যে বিধান রাখা হয়েছে তা দুনিয়ার নিয়মেও অযৌক্তিক। আর শরীয়তের দৃষ্টিতেও এটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। শরীয়তে কারো কাছ থেকে এ ধরনের আর্থিক জরিমানা আদায়ের কোনো বিধান নেই। কোনো কোনো মাযহাবে বিশেষ ক্ষেত্রে আর্থিক শাস্তির যে সুযোগ রয়েছে সেটিও অনেক কঠোর শর্তে এবং বিশেষ ক্ষেত্রের সাথে প্রযোজ্য। নাগরিকদের ওপর মনগড়া জরিমানা চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয়নি। কোনো মাযহাবেই এমন সুযোগ নেই। অথচ সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এ সময়মতো চাঁদা পরিশোধ করতে না পারলে দৈনিক ১% হারে জরিমানার বিধান রেখে সে কাজটিই করা হয়েছে। এটি কুরআন কারীমের নিষিদ্ধ আকলু মালিল গায়র বিলবাতিল’-এর শামিল।

কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনÑ

وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ.

তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না। Ñসূরা বাকারা (০২) : ১৮৮

অন্যত্র ইরশাদ করেছেনÑ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِل.

হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। Ñসূরা নিসা (০৪) : ২৯

ইমাম কুরতুবী রাহ. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেনÑ

والمعنى : لا يأكل بعضكم مال بعض بغير حق، فيدخل في هذا : القمار والخداع والغصوب وجحد الحقوق، وما لا تطيب به نفس مالكه.

আয়াতের অর্থ হলতোমাদের কেউ যেন অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ না করে। এতে লটারিধোঁকা ও প্রতারণাজবর-দখলঅন্যের হক অস্বীকার করা এবং মালিকের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া সম্পদ ভোগ করা অন্তর্ভুক্ত। Ñতাফসীরে কুরতুবী ২/২২৫

শেষকথা

নাগরিকদের বার্ধক্যকালীন সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে এগিয়ে আসা বাহ্যত একটি প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় তো এটি বরং বাধ্যতামূলক এবং সামর্থ্যহীনদের ক্ষেত্রে বিনিময়হীনভাবে করা আবশ্যক। তাই সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’ সর্বাত্মকভাবে প্রশংসা ও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার দাবি রাখতে পারত। কিন্তু সেটি হয়নি এবং হবারও নয়। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার পর এই স্কিম চালু হলেও তাতে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে খুবই সামান্য। যদিও পেনশন স্কিমের চেয়ারম্যান বলেছেনআমরা সামনে প্রচার-প্রচারণা আরো বৃদ্ধি করলে ভবিষ্যতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাবে। এখানে মনে রাখা দরকার যেসরকারের একটি গোষ্ঠী থাকেযারা রাষ্ট্রের টাকা মেরে খাওয়ার চিন্তায় থাকে। তারা মোটা অংকের বেতন-ভাতা নিয়ে একদিকে রাষ্ট্রের টাকা শেষ করে। সাথে আবার প্রচার-প্রচারণার নামে কোটি টাকা খরচ করে। মনে রাখা দরকারইতিপূর্বে এরকম প্রচার-প্রচারণা অনেক চালিয়েছে বিভিন্ন জন। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশাল পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ এসে যাবেÑ এমন ঘোষণা দিয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান সরকারের উপদেষ্টাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসেছেন। তথাকথিত রোড-শো করেছেন। তাতে রাষ্ট্রের কয়শ কোটি ডলার খরচ হয়েছে সেটির হিসাব এখনো তো জনসম্মুখে আসেনি। কিন্তু কী কী বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে এটাও তো এখন পর্যন্ত জানানো বা বলা হয়নি।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী প্রথম মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে (১৭ আগস্ট ২০২৩ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩) অংশগ্রহণ করেছেন ১২,৮৮৯ জন। দ্বিতীয় মাসে (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে ১৭ অক্টোবর ২০২৩) নতুন অংশগ্রহণ করেছেন ১,৮৩১ জন। তৃতীয় মাসে (১৮ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ১৮ নভেম্বর ২০২৩) নতুন অংশগ্রহণ করেছেন ১,১৩৪ জন। তিন মাসে মোট অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা  ১৫,৮৫৪ জন।

সাড়া না পাওয়ার কারণ কীআমাদের দৃষ্টিতে এখানে দুটি কারণ মুখ্য। একটি হলএই স্কিমকে একটি সরকারি সেবামূলক প্রকল্প না বানিয়ে পুরো পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক প্রকল্প বানিয়ে ফেলা হয়েছে। যার ব্যাখ্যা আমরা এই নিবন্ধের শুরুতেই দিয়েছি। যদি টাকা জমা দিয়ে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতোই সুবিধা নিতে হয়এজন্য তো আগে থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকবীমা কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা জনগণের সামনে রয়েছেই। তাহলে মানুষ কেন সরকারের কাছে টাকা জমা করবে। মানুষ চিন্তা করেসরকার একবার আসে আরেকবার যায়। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিক দুর্নীতির কথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে এমনিতেই সরকারের প্রতি গণমানুষের আস্থা থাকে না। সেখানে মানুষ দীর্ঘ মেয়াদে তাকে টাকা দিতেও চিন্তা করবে। এটাই একটা বড় কারণ যেমানুষ তার আস্থা সরকারের প্রতি রাখতে পারছে না। অর্থাৎ এখানে মানুষ দীর্ঘ মেয়াদে টাকা জমা করে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবেসেটা তার কাছে বড় কোনো কিছু মনে হয়নি বা হবেও না।

আর দ্বিতীয় বড় কারণ হচ্ছে ইসলামী। সেটা হচ্ছেএদেশের সিংহভাগ মানুষ মুসলিম এবং তাদের অনেকেই একান্ত বাধ্য না হলে সুদ থেকে বেঁচে থাকতে চায়। নিজের শেষ জীবনে এসে সুদ এবং শরীয়া নিষিদ্ধ কারবার থেকে অর্থ কামাবে এবং সে অর্থ দিয়ে শেষ জীবন চলবেÑ এটা সে চায় না। এ কারণেও অনেকেই এতে যোগ দেবে না। আর শরয়ী বিশ্লেষণ করলে ইসলামের ওপর জীবনযাপন করে এমন মুসলমানের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম২০২৩’-এ যোগ দেওয়ার সুযোগ আসলেও নেই।

মাসিক আল কাউসার থেকে সংগৃহীত।

মূল পোস্টের লিঙ্ক

Leave a Comment

Shopping Cart
Scroll to Top